◑◑জিএম রাশেদ◑◑ চাঁদপুর
চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেয় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া ইব্রাহিমিয়া উজানী মাদ্রাসা। ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ এই মাদ্রাসা ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মরহুম কারী ইব্রাহীম (রহঃ) এর হাতে, যিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযুর্গ এবং হযরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ) এর কাছ থেকে সবচেয়ে কম সময়ে খেলাফতপ্রাপ্ত মনীষী হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন এমন একজন মহান ক্বারী, যিনি সর্বপ্রথম কুরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত করে তোলেন।
উজানী মাদ্রাসার শুরুটা হয়েছিল বন-জঙ্গলে ঘেরা এক এলাকায়, যা পরবর্তীতে আলোর দীপশিখায় রূপ নিয়েছে। কথিত আছে, কারী ইব্রাহীম (রহঃ) নিজ হাতে এই এলাকা পরিষ্কার করে, জমি ক্রয় করে এবং সবার সহযোগিতায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে আজ অবধি এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ইসলামি শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।
এলমে দিন বা ইসলামি জ্ঞানের প্রসারে উজানী মাদ্রাসা একটি অন্যতম নাম। শতবর্ষের বেশি সময় ধরে এ মাদ্রাসা আলেম, মুফতি, ক্বারী এবং ইসলামী চিন্তাবিদ তৈরি করে যাচ্ছে, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বর্তমানে এই মাদ্রাসায় প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত এবং দেড় শতাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োজিত আছেন তাদের পাঠদানে ও পরিচর্যায়।
মাদ্রাসার পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম ও চিত্তাকর্ষক। প্রশস্ত সবুজ মাঠ, পরিপাটি ভবন এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি বিশাল দীঘি রয়েছে যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ওজু ও গোসল করে। এই দীঘি শুধু ব্যবহারিক দিক দিয়েই নয়, এক অনন্য নান্দনিকতারও প্রতীক।
উজানী মাদ্রাসার অন্যতম আকর্ষণ হল এর বার্ষিক মাহফিল ও ইসলাহি জোড়। প্রতি বছর এই দুই বৃহৎ অনুষ্ঠান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত, মুরিদ ও ইসলামপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে। ওলি-আলেমগণের উপস্থিতিতে এই মজলিসগুলো এক অনন্য আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
শিক্ষাদান ছাড়াও এখানকার অনেক শিক্ষক বাংলাদেশজুড়ে ওয়াজ-মাহফিল ও ইসলামি আলোচনায় অংশ নিয়ে ইসলামের বাণী প্রচার করে থাকেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নাম মাওলানা মাহবুবে এলাহী, যিনি বর্তমানে মাদ্রাসার মুহতামিম। তিনি একজন বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার, লেখক ও গবেষক। মাদ্রাসার প্রশাসনিক কাজ শেষে প্রতিদিনই ছুটে যান দেশের নানা প্রান্তে এলমে দিন প্রচারে। তার জীবন উৎসর্গিত ইসলামি শিক্ষার জন্য।
বর্তমান উজানী পীর সাহেবগণ, মাওলানা ফজলে এলাহী ও মাওলানা আশেক এলাহী, দুজনেই তাসাউফ ও ইলমে দিনের ধারক ও বাহক। তাঁরা সারা দেশে ইসলামী শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি উজানী পরিবারের আরো অনেক গুণী আলেম যেমন: মাওলানা এহতেরামুল হক, মুফতি এহেসামুল হক কাসেমী, মুফতি শিব্বির আহমেদ ও মুফতি মাহমুদুল হাসান কাসেমী—যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
উজানী মাদ্রাসার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আরও দুটি বিশেষ স্থান আছে যা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হলো প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বখতিয়ার খাঁ শাহী জামে মসজিদ, যা আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইসলামী ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে। অপরটি হলো প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বাদাম গাছ, যা স্থানীয়ভাবে উজানীর পরিচিতি ও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেকের মতে, এই গাছের নিচেই মরহুম কারী ইব্রাহীম (রহঃ) বসে প্রথম মাদ্রাসার পরিকল্পনা করেছিলেন।
উজানী মাদ্রাসা শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি জীবনদর্শন এবং একটি জাতির আত্মিক জাগরণের কেন্দ্র। আজও প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই পবিত্র স্থান পরিদর্শনে আসেন, আলোকিত হয়ে ফিরে যান।
এই প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা যেন অটুট থাকে, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখান থেকে আলোর সন্ধান পেতে পারে—এই হোক সকলের কামনা।
https://slotbet.online/